12 May 2024

মঙ্গলবার, ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২২

বিষটোপ দিয়ে অবাধে মারা হচ্ছে অতিথি পাখি

Share

আশরাফ আলী, মৌলভীবাজার:
এশিয়ার বৃহত্তম হাওর হাকালুকি। প্রতিবছর শীত মৌসুমে হাকালুকি হাওরে অতিথি পাখির আগমণ ঘটে। শীত প্রধান দেশগুলো থেকে উষ্ণতার খুঁজে প্রাণ রক্ষার জন্য তাদের আবাসস্থল হিসেবে বেছে নেয় হাকালুকি হাওরকে। জীবন রক্ষা করতে এসে বিষটোপ অবাধে মরছে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি।
হাকালুকি হাওরের অবস্থান দেশের উত্তর-পূর্বঞ্চলের মৌলভীবাজার ও সিলেট জেলার ৫টি উপজেলায়। ১৮১ দশমিক ১৫ বর্গকিলোমিটার জলাভূমি এলাকাজুড়ে বিস্তৃত হাওর। এখানে ছোট বড় ২৭৩ বিল ও ১০ নদী ও অসংখ্য খাল রয়েছে। সরকার ১৯৯৯ সালে হাকালুকি হাওরকে পরিবেশগতভাবে সংকটপূর্ণ এলাকা ঘোষণা করে। যদিও জলাভূমিতে পরিযায়ী পাখি শিকার সরকারের নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি জলাভূমিগুলোকে পরিবেশগতভাবে সংকটপূর্ণ এলাকা (ইসিএ) হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। তবুও সেসব এলাকায় পাখি হত্যা চলছে নির্দ্বিধায়। বিভিন্ন কৌশলে স্থানীয় শিকারিরা এখন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজর এড়াতে হত্যার নিষ্ঠুর ও কুৎসিত পথ বেছে নিয়েছেন বিষটোপ!
জানুয়ারি মাসের ২ তারিখে মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলার হাকালুকি হাওরের জুড়ী অংশে নাগুয়া ও চাতলার বিলে পাখি দেখতে ও ছবি তোলার জন্য আসেন ৩ জন আলেকচিত্রি। তাঁরা হলেন সৈয়দ আব্দু, শাহানুল করিম চপল, মোঃ রিজওয়ানুল করিম ও সুলতান আহমদ উপস্থিত। হঠাৎ দেখেন নাগুয়া বিলের মোট ৩২ টি হাঁস পাখির মৃতদেহ। আশেপাশে একটি দুটি করে ধুকে ধুকে মরছে আরো কয়েকটি পাখি। এগুলো বাংলাদেশের পরিযায়ী পাখি পিয়াং হাঁস ও উত্তুরে ল্যাঞ্জা হাঁস।
স্থানীয় কয়েকজন বলেন, শিকারি তারা দল বেধে বিষটোপ ও জাল দিয়ে পরিযায়ী পাখি শিকার করছে। তারা সেসব পাখি গোপনে চড়া দামে বিক্রিও করছে। তবে প্রভাবশালীরা শিকারি দলে থাকায় তাঁরা মুখ খুলে কাউকে এবিষয়ে বলতে পারছে না। চাতলা বিলের ইজারাদার হাবিবুর রহমান বলেন, হাকালুকি হাওরে অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার পাখির সংখ্যা তুলনামূলক অনেক কম। আগে আগে অনেক পাখি দেখতাম এবার এসব চোখে পড়ছে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বড়লেখা উপজেলার আজিমগঞ্জ বাজারের একজন ব্যবসায়ী বলেন, প্রতিদিন ৭/৮ জনের একটি পাখি শিকারি দল পাখি শিকার করে নিয়মিত আমার কাছে পাইকারি পাখি বিক্রি করে। আমি এসব স্থানীয় বাজার ও বসতবাড়িতে বিক্রি করি, এটা কিছুটা লাভজনক। হাওরে পাখি কিনতে পাওয়া যায় কিনা জানতে চাইলে স্থানীয় একজন বলেন, হাকালুকি হাওরের পাখির অনেক দাম। ২টা হাঁস পাখি ১৬০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। অনেকে অগ্রিম অর্ডার দিয়ে রাখেন। আপনার লাগলে অর্ডার দিতে পারেন। এখানে অনেকেই শিকার করে। তবে শর্ত হলো কেনার সময় একা আসতে হবে।
পাথারিয়া বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ টিমের সদস্য খোর্শেদ আলম বলেন, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন-২০১২ অনুযায়ী যে কোনো বন্যপ্রাণী হত্যা, শিকার, ক্রয়-বিক্রয় ও নিজের দখল বন্ধি করে রাখা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু শীত মৌসুমে একটি কুচক্রী মহল পাখি শিকারের মতো নিকৃষ্ট একটি কাজে লিপ্ত। আমরা মানুষকে সচেতন করে যাচ্ছি, তবুও এসব বন্ধ করতে পারছি না।
তিনি আরও বলেন, হাকালুকি হাওরে বাংলাদেশের বেশিরভাগ দেশি প্রজাতির পাখির আবাসস্থল ছাড়াও পরিযায়ী পাখির বিচরণভূমি হিসেবে দেশের অন্যতম জলাভূমি। আইন প্রয়োগের অভাবের কারণে মূলত এটি ঘটে। পাখি বিক্রি কঠোরভাবে বন্ধের সিদ্ধান্ত এখনই নিতে হবে।
পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ এর কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের এসোসিয়েট প্রফেসর এপিডেমিওলজি ও সৌখিন বন্যপ্রাণী চিত্রগ্রাহক ডাঃ মোঃ রিজওয়ানুল করিম বলেন, হাকালুকি হাওরে আমরা মূলত পাখি দেখতে এবং ছবি তোলার জন্য আমরা ৪ জন গিয়েছিলাম নাগুয়া ও চাতলার বিলে। তখন আমরা নিজের চোখে এই নিষ্টুর বিষয় গুলো দেখে হতভম্ব হয়ে যাই। মানুষ মাছ ধরার নামে রাত্রে বিভিন্ন ধরনের জাল ও বিষটোপ প্রয়োগ করে আর ভোরবেলা এসে বিষটোপ খেয়ে মরা এই পাখি গুলো ধরে জবাই করে বিভিন্ন যায়গায় বিক্রি করে থাকে। এসব পাখি খেয়ে মানুষ বিভিন্ন ধরনের জটিল রোগে আক্রান্ত হয় এমনকি মৃত্যু হতে পারে।
তিনি আরও বলেন, এই বিষক্রিয়ায় মৃত পাখিগুলো জবাই করে বিভিন্ন হোটেল গুলোতে পাখির মাংস হিসাবে বিক্রয় করা হয়। ফলে একদিকে জীব বৈচিত্রের অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে অন্যদিকে এইসব বিষযুক্ত পাখির মাংস খেয়ে সাধারণ মানুষ স্নায়ু, কিডনী, লিভারের জটিল রোগে আক্রান্ত হতে পারে এমনকি ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। বয়োবৃদ্ধ মানুষ, গর্ভবতী নারী ও শিশুদের বেলায় এই ঝুকি অনেকগুণ বেশী। এই পাখির মাংস খাওয়া থেকে নিবৃত্ত করার জন্য সকল শ্রেণী পেশার মানুষকে এখনই সচেতন হতে হবে। পাশাপাশি পরিযায়ী পাখি রক্ষায় বন বিভাগ সহ সংশ্লিষ্ট সকলের নিয়মিত প্রশাসনিক মনিটরিং এবং আন্তরিক সহযোগিতা থাকতে হবে।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, বিষটোপ দিয়ে পাখি হত্যার বিষয়টি আমার নজরে আসলে আমি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে আইন শৃঙ্খলা মিটিংয়ে এসব বিষয়ের সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের সাথে কথা বলেছি। এই বিষটা মূলত কৃষি কাজে ব্যবহৃত হয়। এই সুযোগে শিকারিরা পাখি হত্যার কাজে ব্যবহার করে। আমরা অনুসন্ধান করে খুব দ্রæত এদের আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করছি।