ফটোনিউজবিডি ডেস্ক:
সবচেয়ে দীর্ঘ সময় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বাইরে দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি। ক্ষমতার মধ্যে থেকে জন্ম নেওয়া দলটি গত ১৮ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকার ফলে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল দলের সব পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশা-অস্থিরতা বিরাজ করছে। এই দীর্ঘ সময়ে হামলা-মামলা টিকতে না পেরে দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে তৃণমূলের অনেক নেতাকর্মীয় দেশে ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। আবার অনেকে নিজেদের সরকারের রোষানল থেকে রেহাই পেতে এবং ব্যবসা-বাণিজ্য টেকাতে দলটির রাজনীতিও ছেড়ে দিয়েছে।
২০০৬ সালে বিএনপি যখন ক্ষমতা ছাড়ে তখন দলটির শীর্ষ নেতা ছিলেন খালেদা জিয়া। আর দলের মহাসচিব ছিলেন প্রয়াত খন্দকার দেলোয়ার হোসেন। ২০১১ সালে খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের মৃত্যুতে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের দায়িত্ব পান। ২০১৬ সালের দলের কাউন্সিলে তাকে পূর্ণাঙ্গ মহাসচিব করা হয়। অন্যদিকে ২০১৮ সালে ৮ ফেব্রুয়ারি দলীয় প্রধান খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার রাতে সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করা হয়। তখন থেকেই লন্ডনে অবস্থারত তিনিই দলীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
দলটির নেতারা বলছেন, ১৮ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকার সময় বিএনপির শীর্ষ পদে কোনো পরিবর্তন আসেনি। দলের শীর্ষ তিন নেতা হিসেবে আছেন খালেদা জিয়া, তারেক রহমান ও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এই তিন নেতার বিকল্পও দলে তৈরি হয়নি। গত ১৮ বছরের মধ্যে মাত্র ২০১৬ সালেই একবার দলের কাউন্সিল হয়েছে। আর গত ৮ বছরে দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে বিভিন্ন পদে শুধু রদ-বদল করে কাউকে-কাউকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। তবে, জেলা-উপজেলা কমিটিতে এবং দলের অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনগুলোতে কাউন্সিল হয়েছে। এসেছে নতুন নেতৃত্বেও।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক নেতা বলছেন, এতো দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় বাইরে থাকতে হবে- এমন চিন্তা কখনও বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে আসেনি। ২০১৪ সালে বিএনপির টানা আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ নির্বাচন করে ক্ষমতায় চলে যাবে এমন চিন্তা ছিল না। কিন্তু বিএনপির নির্বাচন বর্জনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় বসে অনেকটা নির্বিঘ্নে মেয়াদ শেষ করে। যাতে প্রথম দফায় হতাশ হয় বিএনপি। এরপর ২০১৮ সালের নির্বাচনে আগে সরকার দুর্নীতির মামলা সাজা দিয়ে খালেদা জিয়াকে কারাগারে পাঠায়। বিএনপিও আন্দোলন করে সরকারের চাপ সৃষ্টি করে তাকে মুক্ত করতে ব্যর্থ হয়। ফলে, আন্দোলনের ব্যর্থতা মধ্যে দলের নিবন্ধন ও ভাঙনের হাত থেকে বাঁচাতে বাধ্য হয়ে নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। নির্বাচনে নানা অনিয়মের মধ্যে শোচনীয় পরাজয় ঘটে এবং নির্বাচিত ৮ সংসদ সদস্য শপথ না নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে শেষ পর্যন্ত তা ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। কারণ দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে জোট ও দলের ২ সংসদ সদস্য শপথ নিয়ে নেয়। বাধ্য হয়ে বাকিদের শপথ নিতে অনুমিতি দেয় বিএনপি। যার মধ্যে দিয়ে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বেও প্রশ্নের মুখে পড়ে। আরেক দফায় হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে দলের নেতাকর্মীরা।
দলটির নেতারা আরও বলছেন, হতাশা ও আন্দোলন-সংগ্রামের ব্যর্থতা পাশ কাটিয়ে ২০২৪ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকার পদত্যাগ, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারসহ ১ দাবিতে ২০২২ ও ২০২৩ সাল থেকে জেলা পর্যায় থেকে আন্দোলন শুরু করে বিএনপি। নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যও দেশের বিভিন্ন জেলায় অনেক বড় বড় সমাবেশ ও শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালিত হয়। নেতাকর্মীদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ফিরে আসতে থাকে। এমন অবস্থায় ২০২৩ সালে ১০ ডিসেম্বর দলের নয়াপল্টন কার্যালয়ের সামনে সমাবেশের ঘোষণা দেয় বিএনপি। কিন্তু আগের দিন ৯ ডিসেম্বর পুলিশের সঙ্গে নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। এই ঘটনায় দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ কয়েক শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করে সরকার। আন্দোলনের মধ্যে প্রথম ধাক্কা খায় বিএনপি। নয়াপল্টনে সমাবেশ করার সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে পরের দিন ১০ ডিসেম্বর রাজধানীর গোপীবাগ সমাবেশে করে বিএনপি। ২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে বাংলাদেশে নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বগুলোর তৎপরতা বাড়ে। আসে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা। চাপে পড়ে আওয়ামী লীগ সরকার। বিএনপির নেতাকর্মীরা আত্মবিশ্বাস হয়ে উঠে যে, এবার সরকার পরিবর্তন হচ্ছে। বিএনপি ক্ষমতায় আসতে না পারলেও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে পারছে না। কিন্তু নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে ২৮ অক্টোবর নয়াপল্টন মহাসমাবেশ ‘ক্র্যাকডাউন’ করা হয়। দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে তৃণমূলের কয়েক হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। দেশজুড়ে চলে হামলা-মামলা, নির্যাতন-নিপীড়ন এবং অনেক নেতাকর্মী চলে যায় আত্মগোপনে। ব্যর্থ হয়ে পড়ে চলমান আন্দোলন, যার মধ্যে দিয়ে সর্বশেষ আশাভঙ্গ হয় বিএনপির। ‘একতরফা’ নির্বাচনের মাধ্যমে টানা চতুর্থবার ক্ষমতায় বসে আওয়ামী লীগ।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিএনপি এখন বাংলাদেশের যে কোনো সময়ের চেয়ে সুসংগঠিত একটি দল। এই দীর্ঘ সময়ে নেতাকর্মীরা আন্দোলন করে, যেটা বলে মাটি পুড়ে সোনা হয়, সেটাই হয়ে গেছে। আমাদের তৃণমূলের কর্মীরা কখনও ব্যর্থ হয়নি। সুতরাং এখন আমাদের বিভিন্ন রকম প্রোগ্রাম করে নেতাকর্মীদের একত্রিত করে ভবিষ্যতের জন্য তৈরি হতে হবে।
দলটির ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের নেতা-কর্মীরা হতাশ নয়, তারা কষ্টে আছে। কারণ তারা হামলা-মামলা নির্যাতনের শিকার, ঘর-বাড়ি ছাড়া। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল বিএনপির এমন কোনো নেতা-কর্মী পাওয়া যাবে না, যার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা নেই। এখন তো সরকার আদালতকে নিয়ন্ত্রণ করে তড়িঘড়ি করে অনেক নেতাকর্মীকে সাজা দিয়ে দিচ্ছে।
উপজেলা নির্বাচন বর্জন করার আহ্বান বিএনপির
বিএনপির আগামী দিনের পরিকল্পনা কি জানতে চাইলে মোহাম্মদ শাহজাহান বলেন, পরিকল্পনা তো একটাই সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। কারণ এই সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়, তার প্রমাণ তো হয়ে গেছে। আমরা যে আন্দোলনে আছি, সেটাকে আরও বেগবান করতে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন আদায় করা।
নাম না প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, আমরা স্বীকার করি আর না করি, দলের টপ লেভেল থেকে নীচ পর্যন্ত সবাই হতাশ। বিএনপি তো রাষ্ট্র পরিচালনা করেছে। ফলে, এতো দীর্ঘ সময় ক্ষমতার বাইরে থাকলে হতাশা চলে আসাটাই স্বাভাবিক।
এই নেতা আরও বলেন, এই হতাশা থেকে তৃণমূলের নেতাকর্মী রাজনীতি ছেড়ে দিয়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। আর শীর্ষ পর্যায়ের অনেক নেতা নিজের ব্যবসা-বাণিজ্য টেকাতে দল ছেড়েছে। কেউ-কেউ তো দলও পরিবর্তন করেছে।
বিএনপির আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার জন্য সরকার ও প্রশাসনের গ্রেপ্তার, জেল-জুলুমের পাশাপাশি দলের নেতৃত্ব ও সাংগঠনিক দুর্বলতা দায় বলে মনে করেন দলের স্থায়ী কমিটির প্রবীণ এক নেতা। তার মতে, এবার নির্বাচনের আগে বিএনপি আন্দোলনে বিদেশ নির্ভরতা বেশি ছিল। কিন্তু একটা কথা আমরা বারবার ভুলে যাই যে, কেউ আমাদেরকে ক্ষমতায় বসিয়ে দেবে না। আমরা মাঠ তৈরি করতে পারলে তখন অন্যরা সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে। অন্যথায় কেউ আমার জন্য ঝুঁকি কেন নেবে?
বিএনপির ফরেন উইংয়ের সঙ্গে যুক্ত এক নেতা বলেন, ২০২৪ সালের নির্বাচনে আগে আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্বের ভূমিকার কারণে এখানে এমন একটা অবস্থা তৈরি হয়েছিলো যে- সরকারের পরিবর্তন হচ্ছে। বিএনপি ক্ষমতায় না আসতে পারলেও আওয়ামী লীগ আর ক্ষমতায় থাকতে পারছে না। কিন্তু সেখানে হয়েছে পুরো উল্টো। ২৮ অক্টোবরের পরে বিএনপি রাজনীতির বাইরে চলে গেছে। আর আওয়ামী লীগ রাজনীতিকে পুরোমাত্রায় নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। কূটনৈতিক শক্তিগুলো নিজেদের অবস্থান থেকে সরে আসে।
বিএনপির নেতারা মনে করছেন, আন্দোলনের ব্যর্থতা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে আগে দলের বর্তমান সাংগঠনিক নেতৃত্ব নির্বাচনে সিস্টেমে পরিবর্তন আনতে হবে। এই ক্ষেত্রে নেতাকর্মীদের কাছে জনপ্রিয় নেতাদের শীর্ষ ৩ পদে নিয়ে আসতে হবে। তার সঠিক বাস্তবায়ন করতে হলে যে কোনো সংগঠন ও জেলা-উপজেলা কমিটির শীর্ষ তিন পদ (সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদক) নেতাকর্মীদের সরাসরি ভোটের মাধ্যমে নির্বাচন করার সুযোগ দিতে হবে।
গত এক সপ্তাহে বিএনপির একাধিক নেতাদের সঙ্গে আলাকালে তারা বলছেন, বিএনপিকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি দলের কূটনৈতিক উইংয়কে আরও শক্তিশালী করতে হবে। এতে দক্ষ নেতাদের যুক্ত করতে হবে। কারণ ২৮ অক্টোবরে দলের বিএনপির ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির চেয়ারম্যান আমীর খসরু গ্রেপ্তার হওয়ার পর এই কমিটির কার্যক্রম অনেকটা স্থবির হয়ে পড়ে। কমিটিতে চেয়ারম্যানের পাশাপাশি সদস্য সচিবসহ একাধিক পদ রাখতে হবে। যাতে একজনের অনুপস্থিতিতে অন্যরাও কূটনৈতিকদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারে।
বিএনপির নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির শূন্য পদগুলো পূরণের পাশাপাশি এই ফোরাম পুনর্গঠন হওয়া দরকার বলেও মনে করেন দলের নেতারা। তারা বলছেন, স্থায়ী কমিটির কয়েকজন অসুস্থ এবং বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া ২-৩ জনের স্থায়ী কমিটির সদস্যের নেতৃত্বের গুণাবলি ও বক্তব্য নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করতে পারে না। এসব নেতাদের উপদেষ্টা পরিষদে রেখে নতুন করে নীতিনির্ধারণী ফোরাম ঢেলে সাজাতে হবে। এই ক্ষেত্রে ছাত্রদল করা ৮০-৯০ দশকের নেতাদের অর্ন্তভুক্ত করা প্রয়োজন।
ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, আমরা তো কেবল আন্দোলন থেকে বের হলাম। এতো তাড়াতাড়ি সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব না। এইগুলো আস্তে-আস্তে হবে। দলের পুনর্গঠন করতে তো সময় লাগে। এটা অনেক ভেবে-চিন্তে করতে হবে। আবার বিএনপিতে এমন নেতা নেই যারা জেল খাটে নাই। সবকিছু হিসেবে-নিকেশ করে দলকে পুনর্গঠন করতে হবে।
গত ১৮ বছরে বিএনপি থেকে অনেক কেন্দ্রীয় নেতা পদত্যাগ করেছেন। কেউ-কেউ আবার আওয়ামী লীগেও যোগ দিয়েছেন। সর্বশেষ ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপি ভাইস চেয়ারম্যান শাহজাহান ওপর পদত্যাগ করে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে নৌকা মার্কা নিয়ে নির্বাচন করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। এ ছাড়া বিএনপি থেকে পদত্যাগ করেছেন দলটির ভাইস চেয়ারম্যান মোরশেদ খান, সাবেক বন ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক কর্নেল অব. মো. শাহজাহান মিয়া, অর্থবিষয়ক সম্পাদক মো শাহবুদ্দিন, স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ফাইয়াজ শুভ, নির্বাহী কমিটির সদস্য মেজর অব. হানিফ, আলী আসগর লবি, বিএনপির চেয়ারপারসনের সাবেক উপদেষ্টা উকিল আবদুস সাত্তারসহ অর্ধশতাধিক কেন্দ্রীয় নেতা পদত্যাগ করেন।