ফটোনিউজবিডি ডেস্ক:
দিন দিন বেড়েই চলছে ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। ডেঙ্গু আক্রান্ত হলেই রোগীর শরীরে রক্তের প্লাটিলেট কমতে থাকে। রক্তের প্লাটিলেট কমা মানেই আতঙ্ক— সাধারণ মানুষের প্রাথমিক ধারণা এটাই। প্লাটিলেট ১০ হাজার এমনকি ৫ হাজারে নেমে এলেও ভয় নেই, বলছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, রোগীর শরীরে অন্য কোনও মারাত্মক রোগের উপসর্গ না থাকলে ১০ হাজারের নিচে নামলেও আলাদা করে প্লাজমা দেওয়ার প্রয়োজন হয় না।
আদদ্বীন হাসপাতালের ডা. ফৌজিয়া ইয়াসমিন বলেন, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর শরীরে প্লাটিলেট কমলে রোগী এবং তার স্বজনরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। আসলে প্লাটিলেট কমলেই যে মানুষ মারা যাবে, এমনটা নয়। এমন ভুল ধারণা থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারিভাবে বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচারণা আরও বাড়াতে হবে। তাহলে বিষয়টি বুঝতে মানুষের জন্য সুবিধা হবে।
ডা. ফৌজিয়া বলেন, ডেঙ্গুতে প্লাটিলেট কমা কোনও ঘটনা নয়। এটা নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। যা নিয়ে বেশি ভাবতে হবে তা হচ্ছে, আমাদের শরীরে পানিশূন্যতা বা পানির স্বল্পতা। যাকে ডাক্তারি ভাষায় আমরা বলি ডিহাইড্রেশন, সেটা মেইনটেইন করতে হবে। প্লাটিলেট নিয়ে ভাবতে হবে না। সেটা এমনিতেই বাড়বে।
এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলেছে, ডেঙ্গু আক্রান্ত কোনও রোগীর রক্তচাপ কমে গেলে বা শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ দিয়ে (নাক, মুখ, দাঁত, মাড়ি ও মল) রক্তক্ষরণের মতো উপসর্গ দেখা দিলে; দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে। এরপর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শে চিকিৎসাসেবা চালিয়ে যেতে হবে।
রাজধানী বসুন্ধরার বাসিন্দা টুটুল চৌধুরী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত তার ১২ বছরের একমাত্র ছেলে ঋহানকে ভর্তি করেছেন রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে। তিনি জানান, ৩-৪ দিনের জ্বরের পর ছেলের ডেঙ্গু ধরা পড়ে। প্লাটিলেট কমতে থাকে। যখন ৩৫ হাজারে নামে তখন ছেলেকে হাসপাতালে নিয়ে আসেন। গত দুদিন থেকে সে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠছে। ঋহানকে প্লাজমা দেওয়ার প্রয়োজন হয়নি।
ডেঙ্গু আক্রান্ত আরেক রোগী মইনুল হক প্রায় এক সপ্তাহ রাজধানীর অন্য একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। তিনি জানান, প্রচণ্ড জ্বর, মাথা ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছি। আমার প্লাটিলেট ১৫ হাজারে নেমে যাওয়ায় প্লাজমা দেওয়ার কথা জানান চিকিৎসকরা। সেই প্লাজমা যোগাড় করলেও পরবর্তী সময়ে দরকার হয়নি। আস্তে আস্তে রিকভার করেছি। এখন আমি পুরো সুস্থ।
প্লাটিলেট ১০ হাজারের নিচে নামলেও যেহেতু প্লাজমা দেওয়া বাধ্যতামূলক নয়, তাই ভয় পেতে নিষেধ করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তাহলে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে ভয়টা আসলে কোথায়?
এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক ডা. ফরহাদ মনজুর বলেন, হঠাৎ মাত্রাতিরিক্ত জ্বর, অতিরিক্ত বমি, পেট ব্যথা, অতিরিক্ত দুর্বলতা, দাঁত, নাক, মাড়ি ও মলের সঙ্গে রক্ত যাওয়া; অস্বাভাবিক আচরণ আর সব থেকে বড় বিপদ চিহ্ন রক্তচাপ কমে যাওয়া। সেক্ষেত্রে রক্তের ঘনত্ব জানতে হেমাটোক্রিট পরীক্ষা করতে হবে। মনে রাখতে হবে, ডেঙ্গু হলে রক্তনালী থেকে রক্তের জলীয় অংশ বের হয়ে যায়। যেটাকে আমরা মেডিক্যালের ভাষায় প্লাজমা বলি। এই জলীয় অংশটা রক্তনালী থেকে বের হয়ে পেটে এবং বুকে গিয়ে জমা হলে রক্তটা ঘন হয়ে যায়। ফলে রোগীর রক্তচাপ কমে যায়।
ডা. ফরহাদ বলেন, রোগীর রক্তক্ষরণ, পেটে প্রচণ্ড ব্যথা, পরিচিত লোককে চিনতে না পারা— এসব হলো বিপদ সংকেত। তার মধ্যে যাদের ডায়াবেটিস, প্রেশার আছে এবং বিভিন্ন কঠিন রোগে ভুগছেন— তারা ঝুঁকির মধ্যে থাকেন। অনেক হাসপাতালে প্লাটিলেট কমে গেলেই, অন্য উপসর্গগুলো বিবেচনায় না এনে রোগীকে প্লাজমা দেওয়া হয়। এটা ঠিক সিদ্ধান্ত নয়।
ডেঙ্গুরোগীকে প্লাজমা দেওয়ার ব্যাপারে গাইডলাইনে স্পষ্ট বলা আছে, কখন দিতে হবে। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনায় যে গাইডলাইন রয়েছে, সেটা হালনাগাদ করা হয়েছে। চিকিৎসার সুবিধার জন্য ছোট্ট গাইড বই তৈরি করে চিকিৎসকদের দেওয়া হয়েছে। সেখানে চিকিৎসাপত্র রয়েছে। তবে ৬০ বছরের বেশি বয়সী, শূন্য থেকে ছয় বছরের শিশু; অন্তঃসত্ত্বা নারী এবং যারা দীর্ঘমেয়াদী রোগে ভুগছেন— তাদের বিষয়ে বাড়তি সতর্ক থাকতে হবে।
এদিকে বৃহস্পতিবার (১৩ অক্টোবর) রাজধানীর মহাখালীতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর মিলনায়তনে সারা দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে জরুরি এক ব্রিফিংয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. আহমেদুল কবির জানান, ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ও মৃতের ঘটনা ঘটেছে রাজধানীতে। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তির তিন দিনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি (৪৮ জন) ডেঙ্গু রোগী মারা গেছেন। বয়সের হিসাবে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সবচেয়ে বেশি মারা গেছেন ৪০ থেকে ৫০ বছরের মানুষ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডেঙ্গু সংক্রান্ত এক প্রেজেন্টেশনে বলা হয়, ১ জানুয়ারি থেকে ১২ অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ২২ হাজার ৫১৭ জন। যা গত বছর ছিল ২৮ হাজার ৪২৯ জন, ২০২০ সালে ছিল ১৪০৫ জন। তবে সবচেয়ে বেশি ছিল ২০১৯ সালে ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন। ২০১৯ সালে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১৭৯ জন, ২০২০ মৃত্যু হয় ৭ জনের। আর ২০২১ সালে ১০৫ জন। আর এবছর (১৩ অক্টোবর পর্যন্ত) এখন পর্যন্ত মারা গেছেন মোট ৮৩ জন।