22 November 2024

মঙ্গলবার, ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২২

মৌলভীবাজারে ডাক্তারদের মাফিয়া সাব্বির খান

Share

স্টাফ রিপোর্টার::

ডা. সাব্বির হোসেন খান। মৌলভীবাজার জেলা বিএমএ এর সাবেক সভাপতি। আওয়ামীলীগের রাজনীতির সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত। তিনি মৌলভীবাজারের চিকিৎসা জগতের মাফিয়া। মৌলভীবাজার-২৫০ শয্যা বিশিষ্ট সদর হাসপাতালের সিন্ডিকেটের মূলহোতা। নিয়োগ, টেস্ট ও কমিশন বাণিজ্য তার হাত ধরেই হয়। জেলার বাইরে থেকে কোন ডাক্তার মৌলভীবাজার এসে চেম্বার করলে তাকে নিয়মিত উৎকুচ দিতে হয়, তার কথার বাইরে মৌলভীবাজার সদর কিংবা উপজেলার অন্যান্য হাসপাতালের ডাক্তার, কর্মকর্তা-কর্মচারী, নার্স গেলেই শুরু হতো অপদস্থ করা। তার রোষানলে পড়ে অনেকেই এখানে চাকরি করতে পারেননি, হতে হয়েছে স্থানান্তর। অভিযোগের শেষ নেই ঐ আওয়ামী চিকিৎসকের বিরুদ্ধে। অনেক সাংবাদিককে তার রোষানলে পড়তে হয়েছে। দিয়েছেন কয়েক কোটি টাকার মানহানি মামলা। অভিযোগ উঠেছে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা বিক্ষোভে আহত শিক্ষার্থীদের তিনি  চিকিৎসা না দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন সরকারি হাসপাতাল সহ বিভিন্ন প্রাইভেট হাসপাতালে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, গত ৪ আগস্ট বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শিক্ষার্থী ও জনতার সাথে আওয়ামীলীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ সহ অঙ্গ সংগঠনের সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে আহত শিক্ষার্থীরা মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গেলে তাদেরকে সঠিক চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। অনেকের শারিরীক অবস্থার অবনতি হলে সিলেটসহ বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হন। সূত্র বলছে, বিএমএ এর সাবেক সভাপতি ডা. সাব্বির খান নির্দেশে চিকিৎসক, নার্সরা আহতদের চিকিৎসা দেননি।

সাব্বির খানের মামলার শিকার মৌলভীবাজার প্রেসক্লাবের সিনিয়র সাংবাদিক আজাদুর রহমান বলেন, ২০০৮ সালের মে মাসে ডাক্তার সাব্বির খানের মালকিানাধীন ইউনাইটেড কমপ্যাথ ডায়াগনস্টিক সেন্টারে একজন যুক্তরাজ্য প্রবাসী মহিলা ডায়াবেটিস সহ কয়েকটি টেস্ট করান। সেই রিপোর্ট সিলেট সহ বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ভুল প্রমাণিত হয়। সেই ভুল রিপোর্টের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবেদন করি। এই প্রতিবেদন প্রকাশ হলে ৫ কোটি টাকার মিথ্যা মানহানি মামলা করেন ডা. সাব্বির খান। সেই মামলাটি ২০১৮ সালে যুগ্ম জেলা জজ আদালত খারিজ করেন। ঐ চিকিৎসক আবার ২০২১ সালে আপীল করেন। আপীল মামলাটি এখনও চলমান আছে।

ইমাদ উদ্দিন আহমদ এক শিক্ষার্থী বলেন, হাসপাতালে যাবার পর একজন এসে বলেন তুমি কি আকাম করেছো? বলি আমি কোন আকাম করি নাই। আমি আন্দোলনে ছিলাম। আমার শরীরে আঘাত করা হয়েছে। একথা বলতেই তারা এমনভাবে রিয়েক্ট করে যে আমি বড় কিছু করে এসেছি। তারা আমার ট্রিটমেন্ট করেনি। আমাকে ঘুমের স্যালাইন ও ইনজেকশন দেয় যাতে আমি ঘুমিয়ে যাই। এরপর রাত ১১টার দিকে ডা. পিয়াল হাসান আমাকে কিছু টেস্ট দেন। টেস্টের পর ডাক্তার আমাকে তাড়াতাড়ি সিলেট নিতে বলেন।
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্য করে ডা. সাব্বির খান সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তার নিজের আইডি থেকে একটি পোস্ট শেয়ার করে বলেন, ২৯ টারে বিদায় করছি, লাল কার্ড দেখাইয়া। ভুল বুঝার কিছু নাই, রাজাকার মুক্ত করছি। তার এই পোস্টের স্কীনশট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। উঠে নিন্দার ঝড়। যদিও সরকার পতনের পরে এই পোস্টটি তিনি হাইড করে দেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালের সিনিয়র কয়েকজন নার্স বলেন, হাসপাতালে ডাক্তার সাব্বির খানের একক আধিপত্য ছিল। তিনি যাই বলতেন তাই করতে হত। তার কথার বাইরে যাবার সাধ্য কারও ছিল না। হাসপতালের কেউ না হয়েও তিনি হাসপাতাল নিয়ন্ত্রণ করতেন। এবং তার পছন্দের কয়েকজন ব্যক্তিকে বিশেষ সুবিধা দিতেন। আমরা অসহায় ছিলাম। তিনি আওয়ামী রাজনীতির সাথে জড়িত থাকায় হাসপাতালের কেউ তার বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস করতো না।

সরজমিনে মৌলভীবাজার-শ্রীমঙ্গল রোডে ঢাকা বাসস্ট্যান্ডের কাছে গেলে দেখা যায়, ৭তলা ফাউন্ডেশনের একটি নতুন ভবণের কাজ চলছে। এখানে হাসপাতালের জন্য ৩ কোটি টাকা দিয়ে জায়গা ক্রয় করেছেন ডা. সাব্বির খান। ৫ আগস্টের পর থেকে হাসপাতালের কাজ বন্ধ রয়েছে। সেখানে কাজের দায়িত্বে থাকা শাহিন নামের একজন জানান, হাসপাতালের মূল মালিক ডা. সাব্বির। হাসপাতালের শেয়ারে ২৬-২৭ জন রয়েছেন। ওনি প্রতিদিন এখানে আসতেন। সবকিছু দেখাশুনা করতেন। বর্তমানে ওনি না থাকায় কাজ বন্ধ রয়েছে। তিনি জানান, যারা এখানে শেয়ার আছেন তাদের বেশিরভাগ ডাক্তার ও কয়েকজন ব্যবসায়ী রয়েছেন।

নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক শহরের প্রাইভেট হাসপাতালের একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, তিনি সদর হাসপাতালে নিয়োগ বাণিজ্য, কমিশন বাণিজ্য করে অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন করে তার অনুগত কিছু ডাক্তার ও ব্যবসায়ী নিয়ে তিনি কয়েক কোটি টাকা দিয়ে হাসপাতালটি তৈরি করছেন। তিনি ডাক্তার, প্রাইভেট হাসপাতাল এবং ডায়াগস্টিক সেন্টার থেকে মাসোয়ারা নেন বলে জানান এই ব্যবস্থাপনা পরিচালক।

নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালের একজন গাইনী চিকিৎসক জানান, বিগত ১৫ বছরে আমার কোন প্রমোশন হয়নি ডাক্তার সাব্বির খানের কারণে। তিনি আমাকে বিভিন্নভাবে হেনস্থা করেছেন। আমার বিরুদ্ধে সকল সময় অভিযোগ তুলেছেন আমি নিয়মিত ডিউটি করি না। মূলত ওনাকে টাকা না দিলে বিভিন্ন অভিযোগ তুলতেন।

ডা. ইফতেখার হোসেন মোহন নামের একজন চিকিৎসক জানান, সাব্বির খান ওনার ডায়াগস্টিক সেন্টারে আমাকে নিয়ে হুমকি দিয়েছেন। ডায়াগনস্টিক সেন্টারে আমি কোন টেস্টের জন্য লোক পাঠাই না। সদর হাসপাতালের অনেক ডাক্তার আমাকে বলেছেন ওনাকে টাকা বা ইদে পাঞ্জাবি এরকম কিছু দিয়ে দিতে। তিনি আমাকে স্বাচিপের সদস্য হবার জন্য চাপ দেন। আমি সদস্য না হওয়ায় ফেসবুক সহ বিভিন্ন মাধ্যমে পোস্ট দিয়ে ঘায়েল করার চেষ্টা করেন।

তিনি বলেন, ওনার কথা কেহ না শুনলে তার বিরুদ্ধে প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতে কল দিয়ে বলতেন এই ডাক্তারকে আপনার এখানে চেম্বার করতে দিবেননা। ওনি কাকে টেন্সফার করতে হবে, কাকে পদোন্নতি দিতে হবে এইসব বলে দিতেন। আওয়ামীলীগের ছত্রছায়ায় তিনি এসব অপকর্ম করে বেড়াতেন। ওনার বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে সাহস পেত না।

ডা. মোহন আরও বলেন, একজন আলট্রাসন চিকিৎসকের স্বামী আওয়ামীলীগ নেতা এবং ইউপি সদস্যকে দিয়ে আমাকে ফোনে হুমকি দেওয়ান।

মৌলভীবাজার বিএমএ সদস্য একজন চিকিৎসক বলেন, “কোনো চিকিৎসক উনার কথা মতো না চললে নানাভাবে হেনেস্তা করতেন। তার অনুসারী গুটি কয়েক চিকিৎসক নিয়ে উনি সিন্ডিকেট করেছেন। রোগীকে প্রভাবিত করে তার অনুগতের বাহিরের চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে মামলা হামলার ভয় দেখাতেন।

মৌলভীবাজার পৌর শহরের বেরিরপার এলাকার সাইফুল ইসলাম সোহেল নামে একজন ভোক্তভোগী বলেন, মৌলভীবাজারের চিকিৎসকদের রাজা ছিলেন ডা: সাব্বির হোসেন খান। এ জেলার চিকিৎসা সেবা’কে তিনি ধ্বংস করেছেন। উনার মালিকানাধীন ইউনাইটেড কমপ্যাথ ডায়াগনস্টিক সেন্টারের রিপোর্টে ভুল আসে। ডায়াগনিস্টিক সেন্টার কিংবা ডাক্তারের কাছে হয়রানি অথবা ভুল চিকিৎসার স্বীকার হয়ে উনার কাছে বিচার চাইলে তিনি উল্টো মামলা হামলার ভয় দেখিয়ে বিদায় করে দিতেন।

শহরের অবসরপ্রাপ্ত একজন শিক্ষিকা বলেন, ডা: সাব্বির দলীয় প্রভাবকাটিয়ে ২০১৮ সালে উনার স্ত্রী ডা: জেবীন চৌধুরী সহ তাদের সিন্ডিকেট দিয়ে মৌলভীবাজার মহিলা সমিতির একটি কমিটি করেন। এখন পর্যন্ত অবৈধ কমিটি রয়েছে। কমিটির কয়েকজন ডা: সদস্য উনার স্ত্রীকে সমর্থন না করায় পেশাগতভাবে তাদের হয়রানি করেন।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে মৌলভীবাজার জেলা আওয়ামীলীগের স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা বিষয়ক সম্পাদক ডা. সাব্বির হোসেন খানের ব্যক্তিগত মোবাইল নাম্বরে একাধিকবার ফোন করলে বন্ধ পাওয়া যায়। এমনকি হোয়াটসঅ্যাপে নক দিলেও কোন জবাব পাওয়া যায়নি। পরবর্তীতে উনার ইউনাইটেড কমপ্যাথ ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গেলে পাওয়া যায়নি।