22 December 2024

মঙ্গলবার, ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২২

জেলা পরিষদে চাকরির পরই জিরো থেকে হিরো

Share

বিশেষ প্রতিবেদক::
তারেক আহমদ চৌধুরী চাকুরি করেন মৌলভীবাজার জেলা পরিষদের সহকারি হিসাব রক্ষক হিসেবে। কর্মক্ষেত্রে যোগদানের পরই জিরো থেকে হিরো হয়েছেন তিনি। এরপর আর তাকে পেছনে তাকাতে হয়নি। পেয়েছেন আলাদিনের চেরাগ। সিলেট শহরে কিনেছেন ফ্ল্যাট। শ্রীমঙ্গলে কিনেছেন বাগান। এর বাহিরেও রয়েছে তার ও স্ত্রীর নামে এফডিআর ও ব্যাংক ব্যালেন্স।
তারেক আহমদের বিরুদ্ধে জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার কক্ষে প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো: সাইদুর রহমান’কে মারধর। অফিসে বসে সিগারেট পান। নারীদের সাথে অনৈতিক সম্পর্ক। জেলা পরিষদে একক আধিপত্য বিস্তার সহ অভিযোগের শেষ নেই তার বিরুদ্ধে।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ভুয়া বিল ভাউচার করে টাকা আত্মসাৎ, সরকারি অর্থ রাজস্ব কোষাগারে জমা না দিয়ে আত্মসাৎ, ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে পুরো টাকা আত্মাসৎ, জেলা পরিষদ অফিস, ডাক বাংলো ও অডিটোরিয়াম মেরামতের নাম ভুয়া প্রকল্প তৈরি। বর্তমান জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মিছবাহুর রহমান যোগদানের পূর্ব পর্যন্ত বেপরোয়াভাবে তিনি এসব অনিয়ম করেন। স্টাফরা তার অনিয়মের প্রতিবাদ করলেই মারধর করেন এবং চাকুরিচুত্যির হুমকিদেন। ইতিমধ্যে ৩জন স্টাফকে মারধর করেছেন এবং একজনকে স্বেচ্ছায় অবসরে যেতে বাধ্য করেছেন। যার কারনে ভয়ে কেউই কথা বলতে পারছেননি।

জানা যায়, ২০০৩ সালে তৎকালিন অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের সুপারিশে সহকারী হিসাব রক্ষক হিসেবে মৌলভীবাজার জেলা পরিষদে যোগদান করেন তারেক। জেলা পরিষদে যোগদানের পূর্বে তিনি ডিসলাইনের লাইনম্যান হিসেবে কাজ করতেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সিলেট নগরীর সুবিদবাজার এলাকার ১৮৮ শুভেচ্ছা, মিয়া ফাজিল চিশতে অষ্টম তলা বিশিষ্ট আপন গ্রীণ টাওয়ারের সপ্তম তলায় (সেভেন-ই) ফ্ল্যাটের মালিক তারেক আহমদ চৌধুরী। বিল্ডিংয়ের ম্যানেজর সোহাগ ও দারোয়ান সিরাজ বলেন, টাওয়ারের সপ্তম তলায় (সেভেন-ই) ফ্ল্যাটের মালিক তারেক আহমদ চৌধুরী। তিনি পরিবার নিয়ে এখানে থাকেন। স্থানীয়রা বলছেন এ ফ্ল্যাটের দাম দুই কোটি টাকার উপরে। শ্রীমঙ্গল বিষামনী উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক মাহবুব আলম স্বপ্ন (জায়গা ক্রয়-বিক্রির মিডিয়া) বলেন, ফাইভ স্টার হোটেল গ্র্যান্ড সুলতান এর বিপরীতে বেগুন বাড়ি নামে ১৮ একরের একটি বাগান ছিল তারেক আহমদ চৌধুরী’র। ৬/৭ বছর পূর্বে শ্রীমঙ্গলের পাঁতাকুড়ি সোসাইটির কাছে দেড় কোটি টাকায় বাগান বিক্রি করেন।
এদিকে সদ্য বিদায়ী মৌলভীবাজার জেলা পরিষদের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো: সাইদুর রহমান’কে মারধরের ঘটনায় ২০২১ সালের ২৮ এপ্রিল প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খোদেজা খাতুন কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন সাইদুর রহমান। প্রধান নির্বাহী’র সামনে উপ-সহকারী প্রকৌশলী’কে মারধর করা হয়। কিন্তু অদৃশ্য কারণে বিচার আলোর মুখ দেখেনি। এই ঘটনার পর থেকে আরও বেপরোয়া হন তারেক।
একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, ইলেকট্রিশিয়ান পিয়াস চন্দ্র দাস’কে মেরে পা ভেঁঙ্গে দেন তারেক। চাকুরিচ্যুতির ভয় দেখিয়ে মামলা করতে দেননি পিয়াসকে। বাকবিতন্ডায় জড়িয়ে ঝাড়–দার দুলাল বাসকরকে দুই বছর আগে স্বেচ্ছায় অবসরে যেতে বাধ্য করান তারেক। দুলাল বাসকর যুগান্তরকে বলেন, তিক্ততা আসায় চাকুরি ছেড়ে দিয়েছি। হিসাব রক্ষকের হয়রানির ভয়ে এ বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

পরিষদের একজন নারী কর্মচারীর সাথে তারেকের রয়েছে অনৈতিক সম্পর্ক। পরিষদে প্রশিক্ষণ নিতে আসা মেয়েদের উত্ত্যক্তকরারও অভিযোগ রয়েছে তারেকের বিরুদ্ধে। নাম গোপন রাখার শর্তে চতুর্থ শ্রেণীর এক কর্মচারী যুগান্তরকে বলেন, “দুই আড়াই বছর আগে মৌলভীবাজার ডাক বাংলোর ভিআইপি ৪নং রুম ঝাড়– দেয়ার জন্য বলে কেয়ারটেকার মিন্টু। রুমে ডুকেই হিসাব রক্ষক তারেক এবং জেলা পরিষদের স্টাফ ওই মহিলাকে আপত্তিকর অবস্থায় দেখি। শ্রীমঙ্গল আধুনিক ডাক বাংলায় গত বছর দশমিতে সকাল ১১টায় দুজনই এক সাথে উপর থেকে নিচে নামেন। কেয়ারটেকার দ্রæব বলেছিল কিছু দেখছনি। আমি দেখেও না দেখার বান করি। এক প্রশ্নের জবাবে ওই কর্মচারী বলেন, আমি যোগদানের পর থেকেই শুনে আসছি তাদের দু’জনের অনৈতিক সম্পর্ক। কিন্তু চাকুরির ভয়ে কেউ কথা বলতে পারেন না। সব সময় স্টাফদের মধ্যে দ্ব›দ্ব লাগিয়ে রাখে।
সূত্র বলছে, মৌলভীবাজারেও একটি ভাড়া বাসা নিয়ে তারেক একা থাকেন। রাতে সেই বাসায় বসান আড্ডা।

ইলেকট্রিশিয়ান পিয়াস চন্দ্র দাস বলেন, “ভাই আমার যা হওয়ার হয়ে গেছে, এবিষয়ে আমি আর কিছু বলতে চাইনা। যার সাথে পারব না তাকে নিয়ে মন্তব্য করার সাহস আমার নেই। আমার বউ বাচ্চা নিয়ে থাকতে হবে”।

এবিষয়ে জেলা পরিষদের হিসাব রক্ষক তারেক আহমদ চৌধুরী অভিযোগের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

জেলা পরিষদের ১নং ওয়ার্ডের সদস্য আজিম উদ্দিন বলেন, গত মেয়াদে হিসাব রক্ষকের সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বাকবিতন্ডা হয়েছে। বরাদ্দের তালিকাও উনি করতেন। জেলা পরিষদের অন্যান্য সদস্য ও কর্মচারীরা বলেন পুরো অফিস উনার দখলে।

জেলা পরিষদের ২নং ওয়ার্ডের সদস্য বদরুল ইসলাম বলেন, সামান্য কথা নিয়ে হিসাব রক্ষক সহকারী প্রকৌশলীকে মারধর করেছেন এটা সত্য। আমরা পরিষদের অনেক হিসাব জানতে চাইলে হিসাব রক্ষক আমাদের দেননি। স্বচ্ছতা আনার জন্য আমরা চেয়েছিলাম যারা দীর্ঘ দিন যাবত এখানে কাজ করছে তাদেরকে বদলি করার জন্য কিন্তু পারিনি।

নাম গোপন রাখার শর্তে জেলা পরিষদের একজন মহিলা সদস্য বলেন, নেশা করে একটি বিয়েতে উপস্থিত হয়েছিলেন তারেক। উনার সে দিনের আচরণ জেলা পরিষদের সদস্য হিসেবে আমাদের বিব্রত করেছি।
জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সরদার মোস্তফা শাহীন বলেন, আমি যোগদানের পর হিসাব রক্ষকের কর্মকান্ড শুনেছি। গত সপ্তাহে শুনেছি সে নাকি সহকারী প্রকৌশলী মো: সাইদুর রহমান ও পিয়াসকে মারধর করেছে। তবে পূর্বের স্যাররা বা কর্তৃপক্ষ কি কারণে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেননি জানি না। তবে এ বিষয় গুলো আমি খতিয়ে দেখব।