ফটোনিউজবিডি ডেস্ক::
দেশে ডলারের তীব্র সংকট সৃষ্টি হয়েছেলাগামহীনভাবে বাড়ছে বৈদেশিক এ মুদ্রার দাম। এর বিপরীতে কমছে টাকার মান। নানা পদক্ষেপ নিয়েও দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে খোলা বাজারে ডলারের দাম গিয়ে ঠেকেছে ১২০ টাকায়। চিকিৎসা, শিক্ষা বা ভ্রমণের জন্য যারা বিদেশে যাচ্ছেন তাদের প্রতি ডলার কিনতে খরচ করতে হচ্ছে ১১৯ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ১২০ টাকা পর্যন্ত।
বৃহস্পতিবার (৫ অক্টোবর) কার্ব মার্কেট বা খোলা বাজারে নগদ এক ডলার কিনতে গ্রাহকদের গুনতে হচ্ছে ১১৯ থেকে ১২০ টাকা। যেখানে গত সপ্তাহে এক ডলার ছিল ১১৭-১১৮ টাকা। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত দাম অনুযায়ী খুচরা ডলারের দাম ১১৩ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়।
বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকের এক্সচেঞ্জ হাউজ ও ডলার কেনাবেচার সঙ্গে জড়িতদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বেশিরভাগ মানি চেঞ্জারের কাছে ডলার নেই। যাদের কাছে আছে তারাও সরাসরি ডলার বিক্রি করছেন না। পরিচিত কারও মাধ্যমে ডলার বিক্রি করছেন। প্রতি ডলারে রেট নিচ্ছেন ১১৯ টাকা ৫০ পয়সা থেকে ১২০ টাকা। অর্থাৎ নগদ প্রতি ডলার কিনতে খরচ করতে হচ্ছে ১২০ টাকা পর্যন্ত।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মানি চেঞ্জার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের মহাসচিব শেখ হেলাল সিকদার বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক মানি চেঞ্জারগুলোর ডলারের দাম বেঁধে দিয়েছে। এক্ষেত্রে কেনার রেট ১১১ টাকা ৮০ পয়সা এবং বিক্রির রেট ১১৩ টাকা ৩০ পয়সা। এ দামে কেউ ডলার পাচ্ছে না, তাই মানি চেঞ্জারগুলো এখন শূন্য হাতে বসে আছে।
তিনি জানান, মানি চেঞ্জারগুলো ফাঁকা থাকলেও ট্রাভেল এজেন্সি ও ফুটপাতে ডলার বিক্রি হচ্ছে। কারণ, তাদের কারো কাছে হিসাব দিতে হয় না। তাদের কাছে ডলারের অভাব নেই। দাম বেশি পাওয়ায় গ্রাহকও এখন বিভিন্ন এজেন্সির কাছে ডলার বিক্রি করছে। এজেন্সিগুলোও ইচ্ছেমতো দাম নিচ্ছে। আজ শুনছি এজেন্সিগুলো ১১৮ টাকার উপরে ডলার বিক্রি করেছে।
এদিকে রাজধানীর মতিঝিল ও গুলশান এলাকায় সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, মানি চেঞ্জারগুলোতে খুব একটা বেচাকেনা নেই। হাতেগোনা এক দুইটা মানি চেঞ্জারে লেনদেন হচ্ছে, তাও এর সংখ্যা খুব নগণ্য। এক কথায় অলস সময় পার করছেন বিক্রেতারা। অনেকে দাবি করছেন- ডলার নেই তাই বিক্রি করতে পারছি না।
খোলা বাজারে ডলার ১১৭ টাকা!
কয়েকজন ডলার বিক্রেতা বলেন, বাজারে কেনাবেচা হচ্ছে, তবে কম। কারণ সবার কাছে ডলার নেই। যাদের কাছে ডলার আছে তারা কেনাবেচা করছে। যার কাছে নেই সে বিক্রি বন্ধ রাখবে এটাই স্বাভাবিক।
বিক্রেতাদের দাবি, নির্ধারিত দামে তারা ডলার কিনতে পারছেন না, তাই আপাতত বিক্রিও বন্ধ রয়েছে।
মতিঝিলে ডলার কিনতে আসা শিক্ষার্থী আলামিন হোসাইন বলেন, আগামী ১০ অক্টোবর আমার জার্মানির ফ্লাইট। খরচের জন্য নগদ ডলার কিনতে কয়েকটি ব্যাংক ঘুরেও পাইনি। এখন মানি এক্সচেঞ্জ হাউজ ঘুরেও ডলার নেই। পরে এক পরিচিত ভাইকে ফোন দিলাম এক হাজার ডলার ম্যানেজ করে দিতে। ও জানাল ১২০ টাকা ৫০ পয়সা করে পড়বে। কী আর করব, বাধ্য হয়ে এখন সেটাই নিচ্ছি।
ভারতে স্ত্রীর চিকিৎসা করাতে যাবেন পলাশ চন্দ্র রায় নামের এক বেসরকারি চাকরিজীবী। তিনি গত কয়েকদিন ধরে মানি চেঞ্জারগুলোতে ঘুরছেন নগদ ডলারের জন্য। কিন্তু, খুব একটা সফল হননি। দিনের ব্যবধানে নগদ ডলার সংগ্রহ তার জন্য কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, আমার ৫০০ ডলার প্রয়োজন। গত ১ অক্টোবর ১০০ ডলারের মতো সংগ্রহ করেছিলাম। কিন্তু, দিন যত যাচ্ছে ডলারের দাম তত বাড়ছে। আর ডলার পাওয়াও কঠিন হয়ে যাচ্ছে। কিছু এজেন্সিতে পাওয়া গেলেও দাম অনেক বেশি। পরে বাধ্য হয়ে আজ ১২০ টাকায় বাকি ৪০০ ডলার কিনেছি।
ডলার অর্থায়নে কমলো সুদহার
এ অবস্থায় করণীয় কী— জানতে চাইলে মানি চেঞ্জারদের নেতা শেখ হেলাল সিকদার বলেন, এখন মানি ট্রান্সফার প্রতিষ্ঠানগুলো রেমিট্যান্স সংগ্রহ করছে ১১৪ টাকা ৫০ পয়সায়। সরকারের আড়াই শতাংশ প্রণোদনা যোগ হলে ১১৭ টাকা পড়ছে। এই রেটে মানি চেঞ্জারগুলো ডলার সংগ্রহ করতে পারলে বাজারে ডলার সরবরাহ বাড়বে, দামও ধীরে ধীরে কমে যাবে।
এখন বৈধপথে ডলার কেনা বেচা হচ্ছে না বলেই অতিরিক্ত দাম বাড়ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর গত বছরের মার্চের পর থেকে দেশে ডলার-সংকট শুরু হয়। এ সংকট মোকাবিলায় শুরুতে ডলারের দাম বেঁধে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু তাতে সংকট আরও প্রকট হয়। পরে গত বছরের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম নির্ধারণের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ায়। এ দায়িত্ব দেওয়া হয় ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন-অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ও বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলার অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) ওপর। এরপর দুই সংগঠনের নেতারা ডলারের সর্বোচ্চ দাম নির্ধারণ শুরু করেন।
ডলার সংকট ও বাজার স্থিতিশীলতার জন্য রপ্তানি ও প্রবাসী আয় এবং আমদানি দায় পরিশোধের ক্ষেত্রে ডলারের দাম নির্ধারণ করে আসছে ব্যাংকগুলো। এখন প্রবাসী আয়ে প্রতি ডলারে ১১০ টাকা ৫০ পয়সা দাম দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। রপ্তানি বিল নগদায়নে প্রতি ডলারের বিপরীতে দাম দেওয়া হচ্ছে ১০৯ টাকা ৫০ পয়সা। আর আমদানি ও আন্তঃব্যাংক লেনদেনে দেওয়া হচ্ছে ১১০ টাকা ৫০ পয়সা।
রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি
বাজারে ডলারের সংকট কাটাতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় বা রিজার্ভ থেকে ধারাবাহিক ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ২০২২-২৩ অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে ১৩ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছিল। আর আগের অর্থবছরে ( ২০২১-২২) ডলার বিক্রি করেছিল ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার।
২০২১ সালের আগস্টে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ ছিল ৪ হাজার ৮০০ কোটি বা ৪৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি। সেই রিজার্ভ এখন কমে হয়েছে ২ হাজার ৬৭৪ কোটি (২৬ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন) ডলার। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি বিপিএম ৬ অনুযায়ী, রিজার্ভ বর্তমানে ২ হাজার ৯০ কোটি (২০ দশমিক ৯০ বিলিয়ন) ডলার। প্রকৃত রিজার্ভ আরোও প্রায় তিন বিলিয়ন ডলার কম যা প্রকাশ করছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক।